ভূমিকা
চোখ মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি। এই ছোট্ট দুটি চোখ আমাদের পৃথিবীকে চিনতে, রঙ-আলো দেখাতে ও হাজারো অভিজ্ঞতা লাভে সাহায্য করে। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে আমরা যেভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি, তাতে চোখের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। দিনের পর দিন এই অভ্যাস চোখের জ্যোতি বা দৃষ্টিশক্তিকে ক্ষয় করছে। অথচ কিছু সহজ অভ্যাস, খাবার, ব্যায়াম ও সচেতনতা অবলম্বনের মাধ্যমে চোখের জ্যোতি রক্ষা করা এবং তা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—কীভাবে প্রাকৃতিকভাবে, ঘরোয়া পদ্ধতিতে ও চিকিৎসা সহায়তায় চোখের জ্যোতি বা দৃষ্টিশক্তি বাড়ানো যায়।
চোখের জ্যোতি কমে যাওয়ার কারণসমূহ
প্রথমেই জানা দরকার, চোখের জ্যোতি কেন কমে যায়। সাধারণত নিচের কিছু কারণ থেকে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারে:
অতিরিক্ত সময় মোবাইল/কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখা
ভুল খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টির অভাব
ঘুমের ঘাটতি
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
ধূমপান ও অ্যালকোহল
বংশগত কারণ
বয়সজনিত রেটিনা বা লেন্সের দুর্বলতা
চোখের বিভিন্ন রোগ যেমন গ্লুকোমা, ছানি, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ইত্যাদি
চোখের জ্যোতি বৃদ্ধির প্রাকৃতিক উপায়
১. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে হলে কিছু নির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্য খাদ্যতালিকায় রাখা জরুরি।
ভিটামিন A: চোখের রেটিনার জন্য অত্যন্ত জরুরি। গাজর, পালং শাক, কলিজা, আম ইত্যাদিতে ভরপুর থাকে।ভিটামিন C ও E: চোখের কোষ রক্ষা করে। কমলা, লেবু, বাদাম, সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদিতে থাকে। লুটেইন ও জিয়াজ্যান্থিন: চোখের ম্যাকুলার স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক। শাকসবজি, ডিমের কুসুমে পাওয়া যায়।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: রেটিনা সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছ, ফ্ল্যাক্সসিডে পাওয়া যায়। জিঙ্ক: রাতের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। ডাল, বাদাম, দুধে পাওয়া যায়।
২. চোখের ব্যায়াম
চোখের ব্যায়াম করলে পেশি নমনীয় হয়, রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং দৃষ্টিশক্তি ধরে রাখা সহজ হয়।
পামিং: হাত ঘষে গরম করে চোখের উপর রাখলে চোখ আরাম পায়। আই রোলিং: চোখ ঘড়ির কাঁটার মতো ও বিপরীত দিকে ঘোরান। ফোকাসিং: একটি কলম সামনে রেখে কাছ থেকে দূরে আনুন এবং চোখ দিয়ে অনুসরণ করুন।২০-২০-২০ নিয়ম: প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিন দেখার পর ২০ সেকেন্ড ২০ ফুট দূরে তাকান।
৩. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম
ঘুম দেহের যেমন উপকারী, চোখের জন্যও তেমনই জরুরি। দিনে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে চোখে ক্লান্তি, শুষ্কতা, ফোলা ভাব দেখা দেয়।
৪. চোখ ঠান্ডা রাখুন
শসা, গোলাপজল, ঠান্ডা চা ব্যাগ চোখের উপর ১০-১৫ মিনিট রাখলে চোখ আরাম পায়, রক্তসঞ্চালন বাড়ে এবং জ্যোতি বৃদ্ধি পায়।
৫. পরিষ্কার পানি পান করুন
পানি চোখকে আর্দ্র রাখে। কম পানি খেলে চোখ শুকিয়ে যায়, লাল হয় এবং জ্বালাপোড়া হয়। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি খাওয়া দরকার।
প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা
স্ক্রিনের আলো চোখের ক্ষতি করে। তাই স্ক্রিন ব্যবহারের সময় কিছু নিয়ম মানা জরুরি:
স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা কমিয়ে রাখুন
Anti-glare display screen ব্যবহার করুন
ব্লু লাইট ফিল্টার চালু রাখুন
রাতের বেলা মোবাইল ব্যবহারে 'নাইট মোড' ব্যবহার করুন
নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্ক্রিন থেকে চোখ সরান
চোখের যত্নে ঘরোয়া প্রতিকার
১. ত্রিফলা জল
ত্রিফলা গুঁড়ো রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে নিন। এটি রেটিনা পরিষ্কার করে এবং দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে।
২. গোলাপজল
গোলাপজল দিয়ে চোখ ধোয়া বা তুলো ভিজিয়ে চোখে রাখলে ক্লান্তি দূর হয় এবং চোখ ঠান্ডা থাকে।
৩. শসা ও আলুর ফালি
শসা ও আলু চোখের উপর দিলে ফোলাভাব ও ক্লান্তি কমে যায়। নিয়মিত করলে চোখ ঝকঝকে থাকে।
চোখের সমস্যা এড়াতে যেসব বিষয় এড়ানো উচিত
ধূমপান: রেটিনার ক্ষতি করে, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়
অতিরিক্ত অ্যালকোহল: চোখে শুকনো ভাব সৃষ্টি করে
অতিরিক্ত ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার: রক্তচাপ বাড়িয়ে চোখের উপর প্রভাব ফেলে
অতিরিক্ত রাতজাগা: চোখে অন্ধকার ভাব ও ক্লান্তি সৃষ্টি করে
চোখ চুলকানো: কর্নিয়ায় ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে
চোখের জ্যোতির জন্য মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম
মেডিটেশন ও কিছু যোগ ব্যায়াম চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী। যেমন:
ত্রাটক: একটি মোমবাতির শিখায় নিরবিচারে তাকিয়ে থাকার অনুশীলন। এটি মনঃসংযোগ ও দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
নেত্রস্নান: ঠান্ডা জল দিয়ে চোখ ধোয়া অনুলোম-বিলোম: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
চোখের রোগ ও চিকিৎসা
কিছু সাধারণ চোখের রোগ আছে যেগুলো সময়মতো চিকিৎসা না করলে জ্যোতির হানি ঘটতে পারে:
মায়োপিয়া (নিকটদৃষ্টি): দূরের বস্তু ঝাপসা দেখা হাইপারমেট্রোপিয়া (দূরদৃষ্টি): কাছে ঝাপসা দেখা গ্লুকোমা: চোখের চাপ বেড়ে যাওয়া ক্যাটার্যাক্ট (ছানি): লেন্সে ঝাপসা ভাব ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি: ডায়াবেটিসজনিত রেটিনার সমস্যা
প্রতি বছর একবার চোখের পূর্ণ পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে যারা দীর্ঘসময় স্ক্রিনে কাজ করেন বা যাদের পারিবারিক চোখের রোগের ইতিহাস আছে।
উপসংহার
চোখের জ্যোতি বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কোনো যাদুকরী উপায় নেই। এটি প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস, সচেতনতা ও যত্নের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। সঠিক খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, চোখের বিশ্রাম এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা—এই কয়েকটি বিষয় মেনে চললে চোখের দৃষ্টিশক্তি দীর্ঘদিন ভালো থাকবে, চোখের জ্যোতি শক্তি বৃদ্ধি করার উপায়।
চোখ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। তাই এখনই সময় চোখের প্রতি যত্নবান হওয়ার। কারণ সুস্থ চোখ মানে—একটি আলোকোজ্জ্বল, রঙিন, প্রাণবন্ত পৃথিবী।